জনপ্রশাসন সংস্কারের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা

DC কে জেলা প্রশাসক নামে ডাকা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং দেশের সকল স্থানের জেলা প্রশাসক নামাঙ্কিত সাইনবোর্ড সরিয়ে ডেপুটি কমিশনার করতে হবে।

BCS (Administration) ক্যাডারের নাম পরিবর্তন করে BCS (Land Administration) বা বিসিএস (ভূমি প্রশাসন) করতে হবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এর নাম পরিবর্তন করে জনবল প্রশাসন মন্ত্রণালয় যা ইংরেজিতে Ministry of Public Administration (MoPA) থেকে পরিবর্তন করে Ministry of Personnel Administration (MoPA) করতে হবে।

Senior Services Pool (SSP) ভেঙ্গে দিতে হবে।

কোটা প্রথা বাতিল করে প্রতিটি ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগের উপসচিব পদ সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মেধা/জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পূরণ করতে হবে।

BCS Composition and cadre Rules 1980 অনুসারে BCS (Administration) নামে যে ক্যাডার সার্ভিসটি গঠন করা হয়েছে তার সর্বোচ্চ পদবী Chairman, Land Administration Board. এই সার্ভিসের সিডিউলভূক্ত অন্যতম উল্লেখযোগ্য কিছু পদবী হলো Divisional Commissioner, Director General (Land Records and Survey), Land Reforms Commissioner, Deputy Commissioner, Additional District Magistrate, Senior Assistant Secretary, Upazila Nirbahi Officer, Assistant Secretary (Land Administartion Board), Assistant Commissioner ইত্যাদি। এর মধ্যে Divisional Commissioner বা বিভাগীয় কমিশনার, ম্যাজিস্ট্রেট, Senior Assistant Secretary, Upazila Nirbahi Officer এই পদগুলি মোটামুটি সর্বসাধারনের কাছে পরিচিত। BCS (Administration) ক্যাডার এর পদ হিসাবে সবচেয়ে পরিচিত এবং আলোচিত বা সমালোচিত পদের নাম জেলা প্রশাসক যার ইংরেজি করলে দাঁড়ায় District Administrator যেই নামে BCS (Administration) সার্ভিসের সিডিউলে কোন পদ নেই। তাহলে প্রশ্ন হলো এটি আসলো কোত্থেকে? প্রকৃতপক্ষে BCS (Administration) সার্ভিসের সিডিউলভূক্ত Deputy Commissioner পদটি জেলা প্রশাসক নামে বহুল প্রচলিত। কিন্তু এই নাম পরিবর্তনের আইনগত ভিত্তি কী সেটি পরিষ্কার নয়।

BCS (Administration) ক্যাডারের উপজেলা ইউনিট প্রধান যদি হন উপজেলা নির্বাহী অফিসার, বিভাগীয় ইউনিট প্রধান যদি হন বিভাগীয় কমিশনার তাহলে জেলা ইউনিট প্রধান কেন হবেন জেলা প্রশাসক? সিডিউলভূক্ত Deputy Commissioner সংক্ষেপে DC-ই হলো এই পদের সঠিক এবং যৌক্তিক নাম। DC কে জেলা প্রশাসক নামে ডাকা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে এবং দেশের সকল স্থানের জেলা প্রশাসক নামাঙ্কিত সাইনবোর্ড সরিয়ে ডেপুটি কমিশনার করতে হবে।

BCS (Administration) ক্যাডারভূক্ত পদের সিডিউল দেখলে এটা স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, এই ক্যাডারের কর্মকর্তাগণের মূল কাজ হলো দেশের ভূমি প্রশাসন বা Land Administration পরিচালনা করা যার সর্বোচ্চ পদবী Chairman, Land Administration Board. কাজেই অবিলম্বে এই ক্যাডারের নাম পরিবর্তন করে BCS (Land Administration) বা বিসিএস (ভূমি প্রশাসন) করতে হবে।

বর্তমান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এর পূর্ব নাম ছিল সংস্থাপন মন্ত্রণালয়। কেন নামের এই পরিবর্তন? বাংলাদেশ একটি গণপ্রজাতন্ত্র যার মালিক এই রাষ্ট্রের নাগরিক বা জনগন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা সিভিল সার্ভেন্টরা হলেন রাষ্ট্রের নাগরিক বা জনগনের সেবক বা সেবাদাতা। সিভিল সার্ভেন্টরা কীভাবে জনগনের প্রশাসক হন? জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কি প্রকৃতপক্ষে জনগনের প্রশাসন পরিচালনা করে বা করতে পারে? না, পারেনা এবং তা করেও না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় মূলত প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী বা জনবলের প্রশাসন পরিচালনা করে, তাঁদের নিয়োগ, বদলী, পদোন্নতি, পেশাগত দক্ষতার উন্নয়ন, পুরষ্কার, শাস্তি ইত্যাদি কার্যক্রম পরিচালনা করে। কাজেই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এর নাম পরিবর্তন করে জনবল প্রশাসন মন্ত্রণালয় যা ইংরেজিতে Ministry of Public Administration (MoPA) থেকে পরিবর্তন করে Ministry of Personnel Administration (MoPA) করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের কর্মক্ষেত্রে বর্তমানে ২৬ টি ক্যাডার সার্ভিস আছে। BCS Composition and cadre Rules 1980-এ ৩০টি ক্যাডার সার্ভিসের গঠন, নিয়োগ যোগ্যতা এবং নিয়োগ পদ্ধতি, সার্ভিসের পদবীর তালিকা, বেতন স্কেল, প্রতিটি স্কেলে পদসংখ্যাসহ সার্ভিসের মোট জনবল সংখ্যা নির্দিষ্ট করা আছে। এর মধ্যে ৪ টি সার্ভিস পরবর্তীতে বিলুপ্ত বা অন্য সার্ভিসের সাথে একীভূত হয়ে গেছে। সকল সার্ভিস মিলিয়ে প্রায় সহস্রাধিক পদ থাকলেও ইউএনও, ডিসি, এসপি, ডিআইজি, উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব ছাড়া অন্যান্য পদের নাম দেশের সাধারণ জনগনের মধ্যে খুব একটা পরিচিত নয়। এর মধ্যে ইউএনও, ডিসি পদ দুটি প্রশাসন ক্যাডার এবং এসপি, ডিআইজি পদ দুটি পুলিশ ক্যাডারের পদ। আরেকটি পদ যেটি মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সেটি হলো পুলিশের ওসি যা ক্যাডার পদ নয়। তবে ক্ষমতার ভারে সমাজে এই পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তির প্রভাব সর্বোচ্চ।

উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদগুলি সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগের মূল চালিকা শক্তি। এই পদগুলি কোন ক্যাডারের সিডিউলভূক্ত পদ নয়। কিন্তু মজার বিষয় হলো দেশের আপামর জনগণতো বটেই এমনকি প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের একটা বিরাট অংশও এই পদগুলিকে প্রশাসন ক্যাডারের পদ বলে মনে করে। কাজেই জনগণের মানসপটে দেশে প্রশাসন আর পুলিশ ছাড়া আর কোন ক্যাডার সার্ভিসের অস্তিত্ব নেই। প্রশাসন এবং পুলিশ ছাড়া অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা রাষ্ট্রের কর্মচারী হিসাবে যত গুরুত্বপূর্ণ কার্যই সম্পাদন করুন না কেন, সমাজে তাঁদের অবস্থান একেবারে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে।

প্রশ্ন হলো উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদগুলি কোন ক্যাডারের সিডিউলভূক্ত পদ না হলে এগুলি কোথা থেকে আসে? এই পদগুলি সরকারের Senior Services Pool (SSP) এর অংশ। এই পুল গঠন করার সময় সকল ক্যাডারের ৫ম গ্রেডভূক্ত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মেধার ভিত্তিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে উপসচিব পদে কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়ার নিয়ম করা হয়। এই কর্মকর্তাগণ পদোন্নতি পেয়ে পরবর্তীতে যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে নিযুক্ত হন। কিন্তু পরবর্তীতে মেধার পরিবর্তে কোটা প্রথা চালু করা হয়। বর্তমানে এই কোটা প্রশাসন ক্যাডারের একার জন্য ৭৫% এবং বাকি ২৫টি ক্যাডারের জন্য ২৫% বরাদ্দ। বিসিএস এর এন্ট্রি পরীক্ষায় কোটা প্রথা বাতিলের জন্য প্রায় দেড় হাজার তরুনের প্রাণ বিসর্জন এবং কয়েক হাজার তরুনের পঙ্গুত্ব বরণের মধ্য দিয়ে স্বৈরাচারী শাসকের পতনের পর যখন দেখি আমাদের সন্তানেরা স্বপ্নের বৈষম্যহীন বাংলাদেশে মেধা কোটায় বিসিএস পাশ করে ক্যাডার চাকরিতে যোগ দিয়ে ১০/১২ বছর পর আরও বড় কোটার আঘাত সহ্য করতে হবে তখন মনে হয় হাজারো তরুনের বলিদান আসলে বৃথা। কাজেই প্রজাতন্ত্রের চাকুরীতে আরও বড় বৈষম্যের হাতিয়ার এই SSP কোটা প্রথার এখনি মূলোৎপাটন করা না গেলে জুলাই গণআন্দোলন অর্থহীন হয়ে যাবে। তাহলে এর সমাধান কী?

সরকারের প্রায় ৫৫ টি মন্ত্রণালয়/বিভাগ আছে যার প্রতিটির প্রধান একজন সচিব। সকল মন্ত্রণালয়/বিভাগ মিলে হলো বাংলাদেশ সচিবালয় যা হলো সরকারের নীতি নির্ধারণী কার্যক্রমের কেন্দ্রবিন্দু। প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ এর অধীন রয়েছে এক বা একাধিক অধিদপ্তর যার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে সরকারের নীতি বাস্তবায়ন হয় অর্থাৎ জনগণ সরকারের সেবা পেয়ে থাকে। প্রতিটি ক্যাডার সার্ভিসের একটি নিয়ন্ত্রনকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগ রয়েছে। আধিদপ্তর পর্যায়ে বিভিন্ন ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার কর্মকর্তাগন সরকারের সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করলেও Senior Services Pool (SSP) এর কোটা প্রথার কারণে প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাগণ মন্ত্রণালয়/বিভাগ পর্যায়ে সরকারের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কাজ করে থাকেন। ফলে একেকটি অধিদপ্তর বিশেষায়িত ক্যাডার/নন-ক্যাডার কর্মকর্তার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে যে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করে তার নীতি নির্ধারনী বিষয়ে সেই ক্যাডার বা নন-ক্যাডার কর্মকর্তার বিশেষায়িত শিক্ষা, দক্ষতা বা অভিজ্ঞতার কোন প্রতিফলন সরকারের নীতি নির্ধারনে কাজে লাগেনা। এমতাবস্থায় Senior Services Pool (SSP) ভেঙ্গে দিয়ে প্রতিটি ক্যাডার নিয়ন্ত্রণকারী মন্ত্রণালয়/বিভাগের উপসচিব পদ সংশ্লিষ্ট ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে মেধা/জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পূরণ করা যেতে পারে। যুগ্মসচিব এবং তদূর্ধ্ব পদে আন্তঃমন্ত্রণালয় বদলী করা যেতে পারে পারে। আমরা বৈষম্যহীন বাংলাদেশে দেখতে চাই বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসে যোগদানকারী প্রতিটি ব্যক্তিরই যেন সচিব পর্যন্ত পৌঁছার সুযোগ অবারিত থাকে যা তাঁকে যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা এবং জনসেবার মধ্য দিয়ে অর্জন করতে হবে।

Comments

Leave a Reply