ইসলাম, যা বিশ্বের ১.৮ বিলিয়নেরও বেশি মানুষের দ্বারা অনুসৃত একটি ধর্ম, এর মৌলিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে তাওহীদ (আল্লাহর একত্ববাদ), মুহাম্মদ(সঃ)-এর নবুওত, কোরআন ও হাদিসের কেন্দ্রীয়তা এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ। এই ধর্মীয় ঐক্য সত্ত্বেও, ইসলামের অনুশীলনে বৈচিত্র্যের একটি বিস্ময়কর উদাহরণ পাওয়া যায় যা ইতিহাস এবং বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। এই বৈচিত্র্য কোনো বিভক্তির প্রতীক নয় বরং ইসলামের অভিযোজন এবং তার মূল বিশ্বাসের কাঠামোর মধ্যে নমনীয়তা প্রদর্শন করে। বিভিন্ন মতবাদ, আইনগত স্কুল এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের উত্থান দেখায় যে, ইসলাম একটি ঐক্যবদ্ধ বিশ্বাস হলেও, তা ভিন্ন ভিন্ন ব্যাখ্যা এবং অনুশীলনকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষমতা রাখে।
মৌলিক ঐক্য: ইসলামের ভেতরের বৈচিত্র্যকে বোঝার জন্য প্রথমে এর মৌলিক ঐক্যকে স্বীকার করা প্রয়োজন, যা বিশ্বাস ও অনুশীলনের ভিত্তি তৈরি করে। সমস্ত মুসলমান তাওহীদ-এর উপর বিশ্বাস স্থাপন করে, যা আল্লাহর একত্ব এবং অনন্যতার উপর নির্ভরশীল। কোরআনে বলা হয়েছে, “বলুন, ‘তিনিই আল্লাহ, যিনি এক, আল্লাহ, শাশ্বত আশ্রয়দাতা। তিনি কাউকে জন্ম দেননি, তিনিও জন্মগ্রহণ করেননি, এবং তার সমকক্ষ কেউ নেই” (১১২: ১-৪)। তাওহীদের পাশাপাশি, সমস্ত মুসলমান স্বীকার করেন যে, মুহাম্মদ (স.) হলেন আল্লাহর শেষ নবী। কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুহাম্মদ (স.) নবীদের সমাপ্তি (খাতামুন নবীঈন) (৩৩: ৪০), যা প্রতিষ্ঠিত করে যে তার পরে আর কোনো নবী আসবেন না এবং কুরআন মানবজাতির জন্য চূড়ান্ত বাণী। এই ধর্মীয় নীতির পাশাপাশি, ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ— ঈমানের স্বীকৃতি (শাহাদা), নামাজ (সালাত), দান (যাকাত), রোজা (সাওম) এবং হজ— একটি অভিন্ন কাঠামো প্রদান করে যা সব মুসলমান পালন করেন। এই স্তম্ভগুলো নিশ্চিত করে যে ইসলামের মৌলিক ইবাদত বিশ্বব্যাপী একই।
ধর্মতাত্ত্বিক এবং আইনগত বৈচিত্র্য: ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা ইসলামের মূল বিশ্বাসগুলো নির্দিষ্ট থাকলেও, ধর্মগ্রন্থের ব্যাখ্যা এবং ইসলামি আইনের (শরিয়াহ) প্রয়োগের মধ্য দিয়ে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। এই ব্যাখ্যা প্রক্রিয়া, যা ইজতিহাদ নামে পরিচিত, বিভিন্ন ফিকহের মাযহাব এবং ইসলামি মতবাদের উত্থানে অবদান রেখেছে।
সুন্নি এবং শিয়া মতবাদের ভিন্নতা: ইসলামের ভিতরকার সবচেয়ে বড় বৈচিত্র্য হলো সুন্নি-শিয়া বিভেদ, যা নবী মুহাম্মদ (স.)-এর ইন্তেকালের পর নেতৃত্বের প্রশ্নে শুরু হয়েছিল। সুন্নি মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে মুসলিম সমাজের নেতা বা খলিফা নবীর সাহাবীদের দ্বারা নির্বাচিত হওয়া উচিত, যার শুরু হয়েছিল আবু বকর (রাঃ) এর নেতৃত্বে। অন্যদিকে, শিয়া মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে নেতৃত্ব নবীর পরিবারে থাকা উচিত, যা নবীর চাচাতো ভাই এবং জামাতা আলী (রাঃ)-এর মাধ্যমে শুরু হয়। যদিও এই দুই দল নেতৃত্ব নিয়ে আলাদা, তবুও উভয় সুন্নি এবং শিয়া মুসলমান তাওহিদ, নবুওত, এবং কুরআন সম্পর্কে একই বিশ্বাস পোষণ করেন। তবে, শিয়া মতবাদের মধ্যে ইমামদের ভূমিকা নিয়ে কিছু অতিরিক্ত বিশ্বাস রয়েছে, যাদেরকে আধ্যাত্মিক কর্তৃত্ব এবং ঈশ্বরীয় দিকনির্দেশনার অধিকারী হিসেবে দেখা হয়। বিশেষ করে তাযিয়্যাহ শিয়া মতবাদে ইমামদের এক বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে, যেখানে তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী ইমাম মাহদি একদিন ফিরে আসবেন।
ফিকহের মাযহাব: সুন্নি ইসলামের মধ্যে, চারটি প্রধান ফিকহের মাযহাব রয়েছে— হানাফি, মালিকি, শাফি’ই, এবং হাম্বলি—যাদের প্রত্যেকেরই শরিয়াহ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে নিজস্ব পদ্ধতি রয়েছে। যদিও এই মাদহাবগুলো বিশ্বাসের মৌলিক বিষয়ে একমত, তারা সালাত, উত্তরাধিকার এবং বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে আলাদা রায় দেয়। উদাহরণস্বরূপ, হানাফি মাজহাব, যা দক্ষিণ এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশে জনপ্রিয়, তার ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে আরও যুক্তিনির্ভর এবং নমনীয়। অপরদিকে, হাম্বলী মাযহাব, যা সৌদি আরবে প্রচলিত, অধিকতর শাব্দিক ব্যাখ্যা প্রদান করে। শিয়া আইনতত্ত্ব, বিশেষত জাফারি মাযহাব, কিছু ক্ষেত্রে অনন্য, যেমন মুতা (অস্থায়ী বিবাহ) এবং ইজতিহাদের ব্যাপক ভূমিকা। তবে, এই আইনগত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, উভয় সুন্নি এবং শিয়া শরিয়াহ একই মৌলিক নীতিগুলোর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা কুরআন এবং হাদিসের উপর ভিত্তি করে গঠিত।
সুফিবাদ ও আধ্যাত্মিক বৈচিত্র্য: আইন এবং ধর্মতত্ত্বের পাশাপাশি, ইসলাম সুফিবাদ নামক একটি সমৃদ্ধ আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যও গড়ে তুলেছে, যা আল্লাহর সঙ্গে আধ্যাত্মিক সংযোগের উপর জোর দেয়। সুফি চর্চায় যিকির (আল্লাহর স্মরণ), কবিতা, সঙ্গীত, এবং ওলিদের সম্মান প্রদর্শন অন্তর্ভুক্ত থাকে, যা অনেক সময় আরও রক্ষণশীল ইসলামী ধারার সমালোচনার মুখে পড়ে। তবে, সুফিবাদ ইসলামের প্রচারে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া এবং সাহারা অঞ্চল-এ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে সুফি তরিকার মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিশে গেছে। সুফিবাদ ইসলামের আধ্যাত্মিক দিকটি প্রকাশ করে, যেখানে ব্যক্তিগত অনুভূতি এবং আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের চেষ্টা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, বিখ্যাত সুফি কবি রুমি তার কবিতায় প্রেম এবং আধ্যাত্মিক মিলনের উপর জোর দেন:
“I looked in temples, churches, and mosques. But I found the Divine within my heart.” তিনি বলেছেন “আমি মন্দির, গির্জা এবং মসজিদে খুঁজেছি। কিন্তু আমি আমার হৃদয়ের মধ্যে আল্লাহকে খুঁজে পেয়েছি”।
যদিও অনেক ইসলামিক পণ্ডিত, বিশেষ করে ওহাবী বা সালাফি আন্দোলনের সমর্থকরা, সুফি চর্চাকে নবীর শিক্ষার পরিপন্থী বলে মনে করেন, সুফিবাদ এখনও মুসলিম বিশ্বের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা ইসলামের আধ্যাত্মিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে।
সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক অভিযোজন: ইসলামের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্যগুলোর মধ্যে একটি হলো তার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অভিযোজন করার ক্ষমতা। ইসলাম যখন আরব থেকে আফ্রিকা, এশিয়া এবং ইউরোপে বিস্তার লাভ করে, তখন এটি বিভিন্ন স্থানীয় রীতিনীতি, ভাষা, এবং ঐতিহ্যের সম্মুখীন হয়। অনেক ক্ষেত্রেই, ইসলাম এই স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে মিলে গিয়ে তার মৌলিক বিশ্বাস বজায় রেখেছে। বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম অধ্যুষিত দেশ ইন্দোনেশিয়া-তে, ইসলাম স্থানীয় রীতিনীতির সাথে মিলিত হয়েছে, যেমন ওয়ায়াং (ছায়া নাটক) এবং আদাত (প্রথাগত আইন), যা ইসলামী এবং দেশীয় চর্চার একটি অনন্য মিশ্রণ তৈরি করেছে। একইভাবে, পশ্চিম আফ্রিকায়, সুফি তরিকা যেমন কাদিরিয়া এবং তিজানিয়া ইসলাম প্রচারে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, যেখানে স্থানীয় ধর্মীয় প্রথাগুলো ইসলামী শিক্ষার সাথে মিলিত হয়েছে। এই সাংস্কৃতিক অভিযোজন ইসলামের মৌলিক ধর্মীয় পরিচয় হারিয়ে না গিয়েও বিভিন্ন পরিবেশে বিকাশ লাভ করতে সাহায্য করেছে। কোরআনে এর বার্তাকে সার্বজনীন ঘোষণা করে, পাশাপাশি মানবজাতির বৈচিত্র্যকেও স্বীকার করে:
“হে মানবজাতি, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি এবং তোমাদের বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা একে অপরকে চিনতে পারো” (৪৯: ১৩)
উপসংহার: ইসলামের ভেতরে থাকা বৈচিত্র্য কোনো বিভক্তি বা অসামঞ্জস্যের প্রতীক নয়; বরং এটি ইসলামের অভিযোজন ক্ষমতা ও নমনীয়তার নিদর্শন। তাওহীদ, নবুওত, এবং পাঁচটি স্তম্ভ পৃথিবীর সকল মুসলমানদের মধ্যে অভিন্ন ঐক্যের ভিত্তি তৈরি করে, কিন্তু এই বিশ্বাস ও ইবাদতের ব্যাখ্যা এবং বাস্তবায়ন বিভিন্ন মাযহাব, মতবাদ এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ভিন্ন হতে পারে। এই বৈচিত্র্য ইসলামের সার্বজনীন চরিত্র ও আধ্যাত্মিক গভীরতাকে আরো সমৃদ্ধ করে। ইসলামের এই বহুমুখী চর্চা একে বৈশ্বিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে মানিয়ে নিতে সক্ষম করে তোলে।
সুতরাং, ইসলামী সমাজ গঠনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে, স্থানীয় এবং বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে ইসলামকে সংযুক্ত করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে একটি সমাজ শুধু ঐক্যবদ্ধই নয়, বরং বহুমুখী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে, যা ইসলামের মৌলিক শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তাহলে আমরা (যারা কিনা ইসলামী সমাজ বিনির্মাণ করতে চান ) কি my way or the highway মনোভাবকে কবর দিয়ে ইসলামের বহুত্ব ও বৈচিত্র্যের সহাবস্থান নিশ্চিত করার মধ্যে দিয়ে একটি টেকসই এবং আধুনিক সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখতি পারি?
রিয়াজুল ইসলাম
স্কটল্যান্ড, ইউকে
অক্টোবর ৭, ২০২৪
Leave a Reply
You must be logged in to post a comment.